মুক্তগদ্য

বসন্ত বাহক

মুবিন খান


চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘুম ভাঙল। তখনও ভালো করে আলো ফোটে নি। ফুটবো ফুটবো করছে। ব্যাপার কি জানতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেঁটে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। দেখেন দারোয়ানের সঙ্গে এক লোক মারমুখী ভঙ্গীতে কথা বলছে। রবীন্দ্রনাথ বারান্দায় দাঁড়িয়েই দারোয়ানকে ডেকে জানতে চাইলেন,’এই, কি হয়েছে?’

দারোয়ান কিছু বলে উঠবার আগেই আগন্তুক লোকটা চিৎকার করে উঠল, ‘গুরু! তোমার দরোয়ান আমায় ঢুকতে দিচ্ছে না!’

রবীন্দ্রনাথ লোকটাকে চিনে ফেললেন। উন্মাদটা! দারোয়ানকে বললেন আসতে দিতে। ফটক পেরিয়ে জমিদার বাড়ির সামনের জায়গাটা হেঁটে নজরুল যখন বাড়ির ভেতরে ঢুকল, রবীন্দ্রনাথ তখন সিঁড়িতে। নামছেন। নজরুল গিয়ে সিঁড়ির নিচে দাঁড়ালেন। রবীন্দ্রনাথ সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বললেন, ‘কিরে উন্মাদ, এত ভোরে? ব্যাপার কি?’

নজরুলকে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছিল। মাথার লম্বা এলোমেলো চুলগুলো আরও এখন এলোমেলো । উষ্কখুষ্ক দেখাচ্ছে। বড় বড় চোখ দুটা লাল হয়ে আছে। তাতে উন্মাদের দৃষ্টি। নজরুল নিজেও সেটা জানেন। আর ঠিক এখন, এই মুহূর্তে সকল অস্তিত্ব দিয়ে সেটি অনুভব আর উপলব্ধি করছেন।

নজরুল বললেন, ‘গুরু, আমি তোমায় খুন করব।’

রবীন্দ্রনাথ তাকালেন নজরুলের দিকে। তাঁর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, ‘তুই আমায় খুন করবি! বেশ তো, কর্‌।’

নজরুল তখন পাঞ্জাবির পকেট থেকে গোল করে পেঁচানো কতগুলো কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলেন। রবীন্দ্রনাথ সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ বাকি থাকতেই দাঁড়িয়ে গেলেন।

আর নজরুল তখন স্বর্গ মর্ত্য তালুতে নিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে বেড়াচ্ছেন। বোররাকের পিঠে চড়ে পুরো ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ঘুরছেন। স্বর্গ়ের দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা চেপে ধরছেন। ভগবান শিবের গলায় পেঁচিয়ে থাকা সর্পরাজ বাসুকির ফণা জাপটে ধরছেন। খোদার আসন ভেদ করে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। ভগবারে বুকে লাথি মারতে চাইছেন। বুক ভেঙে দেবেন বলে হুংকার তুলছেন। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।

তাঁর রক্ত লাল চোখ দিয়ে এই আগুন ঝরছে, পরক্ষণেই মুচকি হাসি ফুটে উঠছে ঠোঁটে। এই হাসির নাম পুষ্প হাসি। তিনি তখন জাহান্নামে বসে পুষ্প হাসি হাসছেন। পুষ্প হাসি হাসার কারণ হলো, তাঁর ভয়ে হাবিয়া দোজখের আগুনেরা নিভে যাচ্ছে। আজ তাঁর সকল বাঁধ খুলে গেছে। নিজেকে তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। আবিষ্কার করে ফেলবার পর দেখলেন তিনি একলাই গোটা বিশ্বকে ছাড়িয়ে গেছেন। দেখলেন তিনি নিজেই একটা বিস্ময়। ছাড়িয়ে গেছেন গোটা বিশ্বকে। একলাই। তখন শির উন্নত করে চরম অহংকারে দাঁড়িয়ে গেলেন।

এইরকম যখন অবস্থা তখন তো তাঁকে উন্মাদের মতো দেখানোরই কথা। পড়া শেষ করে নজরুল টকটকে লাল চোখে তাকালেন রবীন্দ্রনাথের দিকে। রবীন্দ্রনাথ এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। পড়া শেষ হতে নজরুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই-ই পারবি আমায় খুন করতে।’

খুব দারুণ একটা গল্প না? শুনে দেহ মনে একটা শিহরণ জাগে না? কৈশোরে আমি যখন এই গল্পটা শুনেছিলাম, আমিও খুব শিহরিত হয়েছিলাম। কিন্তু এই গল্পটার কোনো ভিত্তি নেই। এটা একটা বানানো গল্প। মিথ্যা গল্প। কিন্তু এই গল্পটা একটু ভিন্ন।

এররকম অনেক মিথ্যা গল্প আমাদের সমাজের আনাচ কানাচে ছড়িয়ে আছে। এর চেয়ে ভয়াবহ গল্পও আছে। সাম্প্রদায়িক লোকেদের বানানো গল্প। এই সাম্প্রদায়িক লোকেরা মানুষকে জাত আর ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে পরস্পরের প্রতিপক্ষ বানায়। তারপর পরস্পরকে পরস্পরের ওপর লেলিয়ে দিতে চায়। ফলে এরা সবসময়ই রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বিতর্ক তৈরি করতে সচেষ্ট থাকে। বিভিন্ন গল্প তৈরি করে। গল্পে খুব সূক্ষ্মভাবে বিকৃত তথ্য ঢুকিয়ে দেয়।

আরেকটা গল্প বলি।

নজরুল তখন বেশ নাম করে ফেলেছেন। পত্রিকা বের করেন। গান লেখেন। রেডিওতে তাঁর গান নিয়মিত। এইচএমভি তাঁর গান নিয়ে রেকর্ড করে। তখন এক লোক গেছে নজরুলের কাছে গান চাইতে। কথাবার্তা শেষ হলে নজরুল লোকটাকে দু’দিন পরে এসে গান নিয়ে যেতে বললেন।

তো কথায় কথায় নজরুলকে হাওয়া দিতে লোকটা বলল, ‘দেখেন তো কবি, আজকাল সবাই শুধু রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ করে, আরে কি আছে রবীন্দ্রনাথে? আপনার কাছে তো পাত্তাই পাবে না।’

নজরুল সঙ্গে সঙ্গে তখন জ্বলে উঠলেন। বললেন, ‘কি! কি বললে তুমি! যাও, তোমাকে আমি গান দেব না। যাও তুমি। আরে রবীন্দ্রনাথের লেখা! ও তো বেদবাক্য।’

এই গল্পটা সত্য গল্প। গল্পটা নজরুল গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ একদিন শুনিয়েছিলেন। পরে তাঁর বইতেও উল্লেখ করেছেন।

একটু আগে ভয়াবহ গল্পর কথা বলছিলাম। এবার তার একটা বলি। আসলে গল্প নয়, আমাদেরই অভিজ্ঞতা।

যে বয়সে সাহিত্য কি দ্রব্য সে বিষয়েই আমাদের কোনো ধারণা জন্মায় নি; নোবেল পুরষ্কার কি বস্তু যে বয়সে জানবার সঙ্গত কোনো কারণ নেই, যে বয়সে এইরকম কোনো ধারণা জন্মাবার কোনো যৌক্তিকতাও নেই, সেই বয়সেই আমরা জেনে গিয়েছিলাম, নোবেল পুরষ্কার নামক পুরষ্কারটা আসলে নজরুলের। রবীন্দ্রনাথ ওটা ষড়যন্ত্র করে নিয়ে নিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৌশলে এক হিন্দু মহিলার সঙ্গে কাজী নজরুলের বিয়ে দিয়েছিলেন। পরে সেই মহিলার সহযোগিতায় রবীন্দ্রনাথের লোকজন নজরুলকে বিষ খাইয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথের লোকজনেরা ভালো মানের বিষ খাওয়ায় নি। রবীন্দ্রনাথ বিষ কেনার জন্যে যে টাকাপয়সা দিয়েছিলেন সে টাকাপয়সা তারা মেরে দিয়ে সস্তা ধুতরার বিষ খাইয়ে দিয়েছে। এ কারণেই নজরুল বেঁচে গেছেন। কিন্তু মগজটা বাঁচে নি। মগজটা গেছে। মগজটা ঠিক থাকলে নজরুল লিখে লিখে রবীন্দ্রনাথের নামনিশানা মুছে ফেলতেন।

এইসব ডাহা ডাহা মিথ্যা গল্প ব্যাপক প্রচার পেয়েছিল পাকিস্তান আমলে। পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টিভিতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গান নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানের স্তাবকরা তখন এরকম গল্প বানিয়ে বানিয়ে ছড়িয়ে দিত। প্রতিক্রিয়াশীলদের দৌরাত্বে বাংলাদেশ হওয়ার পরেও সে ছড়িয়ে দেওয়া অব্যাহত থাকতে থাকতে আমাদের প্রজন্মর বালকবেলা ছুঁয়েছিল। আর ভুল ধর্মীয় আবেগের কারণে অনেকে সেগুলো গ্রহণও করেছিল।

অথচ নজরুল সাম্যের কবি। সাহিত্য ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের পশ্চাদপদ, অনগ্রসর এবং অসহায়তার দুঃসময়ে নজরুল ধূমকেতুর মতো উদিত হয়েছিলেন। বিশ্বসাম্য আর মানবিকতার জয়গান গেয়েছেন। কোনো গোষ্ঠী, জাতি কিংবা ধর্মের কবি নন নজরুল। নজরুল মানুষের কবি। সকল মানুষের কবি।

নজরুল রবীন্দ্রনাথকে কবিগুরু ডাকতেন। শ্রদ্ধা করতেন। নজরুল লিখেছেন, ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা করে এসেছি সকল হৃদয়-মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্টদেবতাকে পূজা করে। ছেলেবেলা থেকে তার ছবি সামনে রেখে গন্ধ-ধূপ, ফুল-চন্দন দিয়ে সকাল সন্ধ্যা বন্দনা করেছি। এ নিয়ে কত লোক ঠাট্টা বিদ্রুপ করেছে।’

আর রবীন্দ্রনাথ স্নেহ করতেন নজরুলকে। নজরুল যখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী রবীন্দ্রনাথ তখন কবি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়ে তাঁর লেখা ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যর বইটি পাঠিয়েছিলেন। বইটি তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গপত্রে লিখলেন, ‘জাতির জীবনের বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যখানি কবি নজরুলকে উৎসর্গ করছি।’

নজরুল সম্পাদিত ধুমকেতু পত্রিকার জন্যে আশীর্বাদ বাণী লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
নজরুল যৌবনে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। গীতাঞ্জলির সবগুলো কবিতা ও গান তাঁর মুখস্থ ছিল। কমরেড মোজাফফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘নজরুল ইসলাম বহু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। তিনি কি করে যে রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো মুখস্ত করেছিলেন, তা ভেবে অবাক হই।’ এ কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবহিত হওয়ার পর খুবই খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘আমারই তো মুখস্থ নেই!’

১৯২১ সালে ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ নজরুলকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর নজরুল অনেকবারই শান্তিনিকেতনে যেতেন এবং খুবই কোলাহল মুখর থাকতেন। হৈচৈ করে মাতিয়ে রাখতেন বলে রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁকে ‘হৈহৈ কাজী’ নামে ডাকতেন।

১৯২৮ সালে নজরুল নিজেও তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন ‘সঞ্চিতা’ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। বিভিন্ন রচনায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নানাবিধ উল্লেখ থাকলেও সম্পূর্ণ তাঁকে নিয়ে লেখা কবিতাগুলো হলো ‘নতুন চাঁদ’ গ্রন্থের ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’ ও ‘কিশোর রবি’ এবং ‘শেষ সওগাত’ গ্রন্থের ‘রবিজন্মতিথি’। এরকম অনেক গল্প আছে। বলে শেষ করা যাবে না।

এক গুণী ঠিকই আরেক গুণীকে চিনে নিয়েছিলেন। চিনে নিয়েছিলেন বলেই পরস্পরকে স্নেহ আর শ্রদ্ধার নামে ভালোবাসা দিয়েছিলেন।

যারা অর্বাচীন তারা নিজেরা বিভাজিত হয়। এই বিভাজনে তারা ধর্ম গোত্র সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে। সে মন্ত্রে অন্যকেও বিভাজিত করতে চায়। কিন্তু মহাসমুদ্রকে কি কুয়ায় আটকে রাখা যায় কখনও! দু’জনের আপনাপন কক্ষপথ রয়েছে। তাঁরা নিজেদের সে কক্ষপথ ধরেই পরিভ্রমণ করে চলেছেন। অজ্ঞ আর পথভ্রষ্টরাই কেবল তুলনা করতে চায়।

দু’জনের তুলনা চলে না। বাংলা সাহিত্য আকাশের অন্যতম নক্ষত্র, সাম্য আর দ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন আজ। কবিকে শ্রদ্ধা।❐

Spread the love

You may also like

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *