গল্প

প্রাগৈতিহাসিক

আনিস সাহেব গভীর মনোযোগে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছেন। কবিতা লেখা একটা কঠিন কাজ। কবিতা আসছে না। আসার কথাও নয় অবশ্য। কবিতা ওর জায়গা নয়। তবু মাঝে মাঝে কবিতা লিখে ফেলেন। লিখতে ভালোই লাগে। তবে কবিগণেরা খেপে ওঠেন। তিনি নাকি বাংলা কবিতার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছেন। এই সম্ভাবনা অবশ্য রয়েছে। কিন্তু মাথার জট ছাড়াতে কবিতা বেশ ভালো জিনিস। লেখায় একটা ব্রেক পাওয়া যায়। একঘেয়েমি কাটাতে ব্রেকের দরকার আছে।

প্রেম ভালোবাসা বিষয়ক কবিতা লিখতে হবে। মানবতা বিষয়ক কবিতা লোকেরা খায় না। চটুল প্রেমের কবিতা বেশ খায়। ক্লাসিক সাজে নয়। কবিতাকে হতে হবে আধুনিক সাজের। রঙেদের সমাহার থাকবে কবিতা জুড়ে। উদ্বেলতা থাকবে। চুবিয়ে থাকার মতো ভালোবাসা থাকবে। এইরকম করে লেখা যায়-
‘তোমার ওই টসটসে দু ঠোঁট দেখলেই
ইচ্ছে জাগে ভাইঙ্গা গুঁড়া গুঁড়া করে
এক গ্লাস জলে মিশিয়ে চিনি ছাড়াই
নেড়ে চেড়ে ঢকঢক করে খেয়ে ফেলি।’

ঠোঁট কখনও ভাঙা যায় না। ঠোঁটে হাড় নেই। অতএব ভাঙতে পারার প্রশ্নই আসে না। থেঁতলানো যেতে পারে। ফলে ঠোঁটকে ভেঙে ফেলতে চাওয়ার ভাবনায় একটা নতুনত্ব আছে। বলার ভঙ্গিতে একটা রসবোধ আছে, ইংরেজিতে এটাকে বলে সেন্স অব হিউমার। এর কারণে পাবলিকে খাবে। তাছাড়া সাহিত্যর প্রথাগত যে ধারাটা রয়েছে, সেটাকেও ভাঙা দরকার। নতুন ধারায় ভাবতে হবে, লিখতে হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে ঠোঁট ভাঙতে চাওয়াটা এখানে রূপক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। জল খাওয়া না হয়ে অবশ্য পানি পান হলে ভালো…ভাবনায় ছেদ পড়ল,

-এই শুনছ? নেপালে নাকি বাংলাদেশের প্লেন ক্র্যাশ করেছে!’

-‘তাই নাকি! আচ্ছা দেখব পরে, নিউজ ফিডে খবর আসুক। এখন কবিতা লিখছি, বিরক্ত কোরো না।’

-‘আহা শোন না, অনেক মানুষ নাকি মারা গেছে।’

-আচ্ছা বললাম তো দেখব নে। শোন, একটা কাজ কর তো। আমার ক্যামেরাটা নিয়ে লেন্সটা তালু দিয়ে চেপে ধরে একটা স্ন্যাপ তুলে দাও তো।’

-‘কোনও ছবি তো উঠবে না! কালো হয়ে থাকবে!’

-‘ওটাই দরকার।আপলোড দিয়ে দিব। পরে এডিটে গিয়ে টেক্সট বসিয়ে একটা শোকবার্তা লিখে দিলে চমৎকার দেখাবে।’

এখন শোকবার্তা লিখতে হবে। বেশি বড় করা যাবে না। দুই লাইনের হতে হবে। কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে ধবধবে সাদা অক্ষরে লেখা জ্বলজ্বল করতে থাকবে। নাকি লাল অক্ষরে লিখবেন? লাল রঙটা রক্তর প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। দুর্ঘটনার মৃত্যুতে রক্তারক্তির একটা ব্যাপার থাকে। নীল রঙও হতে পারে। ব্যথার রঙ নীল। প্লেন দুর্ঘটনায় অনেকগুলো মানুষের মৃত্যুতে তিনি ব্যথিত হয়েছেন। ভাবতে ভাবতে আনিস সাহেব টেলিভিশন রুমে এলেন। সবগুলো চ্যানেলে নেপালে প্নেন ক্র্যাশের খবর।

ব্রেকিং নিউজ চলছে। প্রতি মুহূর্তর খবর তাৎক্ষণিক প্রচার করা হচ্ছে। লাইভ টেলিকাস্ট চলছে। টক শো’র আয়োজনে বিশেষজ্ঞদের ভীড়। একেকজনের কথা শুনে মনে হচ্ছে এরা বোধহয় দুর্ঘটনার সময় ককপিটে পাইলটের পাশেই বসেছিল। বসে বসে পাইলটকে সুপরামর্শ দিয়েছে। পাইলট তার পরামর্শ শোনেন নি বলে প্লেনটা ক্র্যাশ করেছে। শুনলে আর করত না।
আরেকদল প্লেন নামক যন্ত্রটার এমন বর্ণনা দিচ্ছে যে ওই বর্ণনা শোনার পরে যন্ত্রপাতি জোগার করতে পারলে যে কেউই একটা গোটা প্লেন বানিয়ে ফেলতে পারবে। আহত নিহতর খবর ছাড়া খবরে আসলে বিশেষ কিছু নেই। একই খবর ঘুরেফিরে দেখাচ্ছে। উদ্ধার অভিযান চলছে।

আনিস সাহেব মোবাইল ফোনটা হাতে নিলেন। অনলাইনে কি চলছে একটু দেখা দরকার। শোকমাখা কালো ছবিটাও প্রোফাইলে আপলোড করা দরকার। ছবিটা তো এখনও দিয়ে গেল না। মোবাইল ফোনেও অবশ্য তোলা যাবে। ওহ! শোকবার্তাটা তো লেখা হলো না। লিখে ফেলতে হবে।

যা ভেবেছিলেন। টাইমলাইনে প্লেন ক্র্যাশ নিয়ে বিরাট হৈচৈ চলছে। এইখানেও বিশেষজ্ঞ আছেন, আছেন শোকের মাতমকারী, প্রতিক্রিয়াশীল, নারীবিদ্বেষী, নারীবাদী, দালাল, রাজনীতিক, কর্পোরেট; আরও যে কত তার ইয়ত্তা নেই। সকলেই নিজের নিজের ফরম্যাটে তাদের মূল্যবান চিন্তা-ভাবনা-কথাবার্তা বলে চলেছেন। বলেই চলেছেন। দেখা গেল টেলিভিশনের টক শো’র চাইতে এরা কম জানেন না। কম যানও না।

এদের মধ্যে এক ভদ্রমহিলার বক্তব্য আনিস সাহেবের মনোযোগ কাড়ল। ভদ্রমহিলা ‘আবাল’ বাঙালিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এয়ারক্র্যাফটের বাংলা প্রতিশব্দ বিমান নয়, উড়োজাহাজ। আমাদের জাতীয় এয়ারলাইন্সের অফিসিয়াল নাম বিমান। এয়ারলাইন্স মানেই বিমান নয়। উড়োজাহাজের শাব্দিক অর্থ আকাশযান। যে উড়োজাহাজ বা আকাশযানটা ক্র্যাশ করেছে সেটি বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের নয়। প্লেন ক্র্যাশ কিংবা নিহতদের নিয়ে কোনও কথা বলেন নাই। একটু পরেই জানা গেল ভদ্রমহিলা বিমানের কর্মী। বোঝা গেল সেকারণেই প্লেনকে বিমান বলায় খেপেছেন।

আনিস সাহেব ভারাক্রান্ত মন নিয়েও খুব মজা পেলেন। তার ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখাও ফুটে উঠল। প্লেন ক্র্যাশ, এতগুলো মানুষের মৃত্যু কিংবা অব্যবস্থাপনা, কোনকিছুই ভদ্রমহিলার মনে দাগ কাটে নি। তিনি উত্তেজিত কারণ লোকে ক্র্যাশ হওয়া এয়ারক্র্যাফটকে বিমান বলছে বলে! তবু একদিক থেকে ভালো। ভদ্রমহিলা স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছেন।

ইস্‌! কত্তগুলো মানুষ মরেছে। নিজের মানুষের মৃত্যু বড় কষ্টের। এই কষ্ট কাউকে বলে বোঝানো যায় না। কেবল অভিজ্ঞতা দিয়েই অনুভব করা যায়। সকল মানুষের প্রাণই মূল্যবান। মহামূল্যবান।
তবে সব খবর অন এয়ারে আসে না। র’ খবর পরিবেশন করা যায় না। খবরকে সাজিয়ে গুছিয়ে পোশাক পরিয়ে পরিবেশন করতে হয়। র’ খবরের আশায় আনিস সাহেব তার একবন্ধুকে ফোন করলেন। বন্ধুটি একটি দৈনিক পত্রিকার বিভাগীয় সম্পাদক। অনেকক্ষণ ফোন বাজবার পর বন্ধুটি ফোন তুলল। তুলেই বলল,
-‘যা বলার জলদি বল্। একদম সময় নাই।’

-‘প্লেন ক্র্যাশ নিয়ে ব্যস্ত?’

-‘নারে, প্লেন ক্র্যাশের পরবর্তী ধাক্কা নিয়ে ব্যস্ত।’

-‘কি রকম বল্ তো!’

-‘বিজ্ঞাপন নিয়ে ব্যস্ত। প্লেন ক্র্যাশ করার পর থেকে প্রচুর বিজ্ঞাপন আসছে। কালকের হেডলাইন যে প্লেন ক্র্যাশের খবর সেটা সবাই বুঝে গেছে। এখন বিজ্ঞাপন নিয়ে আসছে। সবাই প্রথম পাতা আর শেষ পাতা চায়। রেট ডবল করে দিলেও কমছে না। ম্যানেজ তো করতে হবে। আচ্ছা শোন্, রাখি। পরে কথা হবে।’

লাইন কেটে গেল। কিন্তু কিছুই জানা গেল না। বন্ধুকে বলা হলো না, বিজ্ঞাপনের ঝামেলা মেটাতে তো বিজ্ঞাপন বিভাগের লোক রয়েছে। বিভাগীয় সম্পাদক ওটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে কেন? তবে বিজ্ঞাপন বিষয়ক কৌতুহল নির্মিত হলো।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কি অবস্থা জানতে ইচ্ছে করছে। আতিককে ফোন করে খোঁজ নেওয়া যায়। আতিক একটা টেলিভিশন চ্যানেলের বিজ্ঞাপন ম্যানেজার। ছেলেটা আনিস সাহেবকে খুব খাতির করে। আনিস সাহেব আতিককে ফোন করলেন। আতিক ফোন ধরল না। তবে দু মিনিট পরেই পাল্টা ফোন করল।

-‘স্লামালাইকুম আনিস ভাই। ফোন করেছিলেন?’

-‘হ্যাঁ আতিক। এমনি খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফোন করলাম। অনেকদিন তোমার খরবাখবর নাই। বাসায় টাসায়ও তো আসো না। তাই ভাবলাম একটু খোঁজ নেই।’

-‘আর বইলেন না আনিস ভাই, কাজের চাপে আসা হয়ে ওঠে না। আর আজ তো নিঃশ্বাস ফেলারও টাইম নাই। ফোনও ধরছি না। দেখেন না আপনার ফোনও ধরি নাই। আপনার মিসড্ কল দেখে ফোন করলাম।’

-‘কেন! আজ এত কী হলো! এত ব্যস্ত কেন আজ?’

-‘দুপুরে নেপালে প্লেন ক্র্যাশ করেছে জানেন না! তারপর থেকে তো নিউজ রুম পুরা ব্যস্ত। আর তাদের চেয়ে বেশি ব্যস্ত আমরা।’

-‘তোমাদের কাজ তো বিজ্ঞাপন নিয়ে। তোমাদের তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানোর কথা। তোমাদের অত ব্যস্ততা কীসের!’

-‘প্লেন ক্র্যাশ করার পর থেকেই বিজ্ঞাপন দাতাদের ভীড় চারগুণ হয়ে গেছে। টক শো’র স্পন্সর ডবল হয়েছে। সারাদেশের মানুষের চোখ তো এখন টিভির দিকে, এজন্যে। আমরা মিনিটের দাম বাড়ায়ে দিছি। তবুও ম্যানেজ করা যাচ্ছে না।’

আনিস সাহেব শব্দ করে হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আতিক, এই মাসের কমিশন দিয়ে তো তুমি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক বনে যাবে হে!’

শুনে আতিকও হাসল। একটু লজ্জাও পেল যেন। বলল, ‘আনিস ভাই যে কি সব বলেন না!’ কমিশনের অঙ্কটা বোধহয় হিসেব করে ফেলেছে। তারপর ব্যস্ততা কমলে বাসায় আসবে কথা দিয়ে ফোন রাখল আতিক।

আচ্ছা জল, স্থল আর আকাশপথে দুর্ঘটনার অনুপাত কি করা হয়? আনিস সাহেব জানেন না। পরিসংখ্যান নিশ্চয়ই করা হয়? করলে কারা যে করে, জানতে পেলে ভালো হতো। একটু পরে আনিস সাহেবের ফোন বাজতে লাগল। অপরিচিত নম্বর। অপরিচিত নম্বরের ফোন ধরতে ইচ্ছা করে না। আনিস সাহেব অনিচ্ছা নিয়ে ফোন ধরলেন, ‘হ্যালো, আনিস স্যার বলছেন?’

-‘বলছি।’

-‘স্যার, আমি তৌহিদ। ভালো আছেন?’

-‘হ্যাঁ, ভালো আছি। কি খবর তৌহিদ?’

-‘স্যার, নেপালে দুর্ঘটনায় বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় কাল বিকেলে আমরা একটা মৌন মিছিল করার কর্মসূচী নিয়েছি। মিছিলটি শাহবাগ থেকে প্রদক্ষিণ করে টিএসসি গিয়ে থামবে। সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে নিহতদের আত্মার জন্যে শান্তি কামনা করা হবে।’

-‘খুবই ভালো উদ্যোগ নিয়েছ তৌহিদ। প্রশংসা করছি। কিন্তু প্রোগ্রামটা আজ করলে ভালো হতো না?’

-‘হ্যাঁ স্যার, আজ করলে ভালো হতো। কিন্তু আপনি তো জানেন আমাদের বাজেটের অবস্থা। ফান্ড জোগার করতে হবে। আমরা জোগার করতে শুরু করে দিয়েছি। ব্যানার করতে দেওয়া হয়ে গেছে। সবাইকে জানাতেও তো সময় লাগবে।’

-‘হ্যাঁ, তা অবশ্য লাগবে।’

-‘আপনাকে সেটা জানাতেই ফোন করে বিরক্ত করলাম স্যার। আমরা চাইছি আপনি আমাদের মৌন মিছিলের অংশ হোন। আরও অনেক বিশিষ্টজনেরা থাকবেন। কাল বিকেলে শাহবাগ মোড়ে চলে আসবেন স্যার।’

-‘আচ্ছা ঠিক আছে, দেখা যাক।’

-‘দেখা যাক না স্যার, আপনাকে আসতেই হবে।’

আনিস সাহেবের ভালো লাগছিল না। ‘হ্যাঁ’ বলে ফোন রাখলেন।

তৌহিদ ছেলেটা দুর্ঘটনায় বিমান বিধ্বস্ত বলেছে। এটা কানে বেজেছে। সেই ভদ্রমহিলার কথা মনে পড়ল। লোকেরা বিমান দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত বলেছে বলে ভয়াবহভাবে খেপেছেন। বিরাট একটা লেখা লিখে ফেলেছেন।

তৌহিদ কী এই ভদ্রমহিলাকে ফোন করতে পারে? বাংলাদেশে তো বিশিষ্টজন নাগরিকের অভাব নেই। করতেও পারে। আনিস সাহেব তৌহিদের জন্যে মায়া অনুভব করলেন। রাজনীতি মানুষকে দিয়ে কত কী করায়! শুধু রাজনীতির দোষ দিয়ে লাভ কী? পেশাজীবীরাও করছে। তিনি নিজেও কি করছেন না? করছেন তো।

ওহ্! কালো ছবিটা আপলোড করা হয় নি। শোকবার্তাটাও লেখা বাকি। একটা পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধও লিখে ফেলতে হবে। কবিতাটাও তো লেখা হলো না। হারিয়ে গেল না তো! কি যেন ভেবেছিলেন?

‘তোমাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে চিনি
মেশাবো; অতঃপর…
ধুরো! এটা কোনও কবিতা হলো! যাহ হারিয়েই গেল। আবার নতুন করে ভাবতে হবে। পরে ভাববেন। এখন প্লেন ক্র্যাশটাকে ধরতে হবে। পুরনো হয়ে যাওয়ার আগেই ধরতে হবে।

আনিস সাহেব তার লেখার টেবিলের দিকে এগুতে লাগলেন।

Spread the love

You may also like

Leave a reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *